এহসান বিন মুজাহির

  ২৯ আগস্ট, ২০১৯

বাংলা সাহিত্যের নির্ভীক কলমযোদ্ধা

চেতনা, জাগরণ, দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক বিরল সাহিত্যব্যক্তিত্ব। আজ ২৯ আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। বাংলা সাহিত্য জগতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মৌলিক কাব্য-প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন বলেই এখনো তিনি যুগ প্রবর্তক কবি হিসেবে স্বীকৃত। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শুধু উন্নত ও সমৃদ্ধই করেননি, বিশ্বদরবারে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিতও করেছেন।

বিদ্রোহী কবি বলে সমধিক খ্যাত কবি নজরুল ইসলামের মরমি কবিতা, অসংখ্য গজল, গান, হামদ-নাত আজও পাঠক-শ্রোতাকে সমভাবে আপ্লুত করে রাখে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল যে বিশাল সাহিত্য ভান্ডার রচনা করেছেন, তার তুলনা বিরল। তিনি যে কত বড় কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। জাতীয় কবি, নিপীড়িত মানুষের কবি, তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল মূলত একজন কবি হলেও সাহিত্যের সবস্তরে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

নজরুল শুধু শিল্পী-সুরকার, গীতিকার, কবি, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক ও আপসহীন সৈনিকই নন। তিনি ছিলেন সেকালের শক্তিধর এক কলমযোদ্ধা। তার লিখনীতে ফুটে ওঠেছে বিদ্রোহী মানুষের চাওয়া-পাওয়া। কবি তার ক্ষুরধার লিখনীর মাধ্যমে অন্যায়, জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন; যা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল বজ্রের ন্যায় কঠিন, ‘হিরার’ চেয়ে ধারালো। তিনি সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশের মজলুম মানুষকে সরাসরি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কলমযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

দৃপ্তকণ্ঠে তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালি কলমসৈনিক যিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘কারার ঐ লোহ কপাট/ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/রক্ত জমাট/শিকল পূজায় পাষাণ বেদি/ওড়েও তরুণ ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ধ্বংস নিশান/উড়ুক প্রাচীর/প্রাচীর ভেদি। তিনিই পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতিকে। তার জাগরণী ও বিদ্রোহী কবিতা, লাথি মার ভাঙরে তালা/যত সব বন্দি-শালায়/আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি। ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল’। বল বীর, চির উন্নত মম শির। বা মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত, এমন সাহসী কাব্য লেখনীর মাধ্যমে এ দেশবাসীকে জাগিয়েছেন। পরাধীনতা, শোষণের কবল থেকে জাতিকে প্রথম স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন, জাগ্রত করেছেন জাতীয়তাবোধ। তার কলম শাসকের অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিমান ছিল। এসব কারণেই তিনি বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুল স্বপ্রতিভায় চির সমুজ্জ্বল।

কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প ও গান-গজল সব শাখাতেই বিচরণ ছিল কাজী নজরুল ইসলামের। কেবল গানই সৃষ্টি করেছেন চার হাজারের কাছাকাছি। এত গান পৃথিবীতে আর কোনো কবি-গীতিকার লিখেছেন বলে জানা নেই। গান ছাড়াও রয়েছে তার অজস্র ছড়া-কবিতা। লিখেছেন বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস। লেখালেখির পাশাপাশি সুর সৃষ্টি ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। এমনকি চলচ্চিত্র পরিচালক, সুরকার, গায়ক ও অভিনেতা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। নবযুগ, অর্থ সাপ্তাহিক, ধূমকেতু, লাঙল ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন জামানার কাঁটাভরা দুর্গম পথের এক নির্ভীক সাংবাদিকও। তিনি বড়দের জন্য লিখেছেন অনেক অনেক প্রবন্ধ-গল্প ও কবিতা। তাই বলে নজরুল ছোটদের ভুলে থাকেননি। নজরুল ছোটদের জন্য রেখে গেছেন শিশুসাহিত্যের এক সুবিশাল ভান্ডার।

বড় দুঃখের বিষয় হলো যে, নজরুল একজন মানবতাদী কবি, যিনি সাধারণ মানুষের জন্য লিখেছেন, মানবতার গান গেয়েছেন, স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সত্য, কিন্তু আমরা আজ তাকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। নজরুলকে উচ্চাসনে বসিয়ে দিয়ে তার থেকে মই কেড়ে নিয়েছি। নজরুল যে বিদ্রোহের গান গেয়েছিলেন, সেই বিদ্রোহ আজ রহিত হয়ে গেছে! বাঙালি মুসলমান আজ নির্জীব-অসার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে নজরুলের অবস্থান দেখলে মনে হবে যে, বাংলার সবচেয়ে অপ্রসিদ্ধ কবি!

নজরুল নিভু নিভু আলোয় কোনো মতে টিকে আছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে বাংলা বিভাগ রয়েছে, সেখানে নজরুল সাহিত্য থেকে স্বল্প পরিসরে কবি নজরুলকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশে নজরুল অনুশীলন অত্যধিক মাত্রায় কম হচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলচর্চায় যে অবদান রাখছে, তাও খুব সামান্য। বাংলা একাডেমিও উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখছে না। জাতীয় পর্যায়ে নজরুলচর্চা আমাদের দেশে হচ্ছেই না বললেই চলে। আমরা তাকে চেতনায় ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কবি নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন অন্য সব কবির চেয়ে ভিন্নমাত্রায় বেশি হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু হচ্ছে এর বিপরীত।

অন্যান্য কবির জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে যেভাবে বর্ণিল বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা ও নানা আয়োজন করা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বেলায় এমনটি চোখে পড়ে না। তাইতো কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী দুঃখভরা কণ্ঠে বলেছেন, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চর্চা শুধু জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতেই সীমাবদ্ধ। এই দুটি দিন ছাড়া কবিকে সেইভাবে চর্চা বা স্মরণ করা হয় না। যা সত্যিই কিন্তু দুঃখজনক। অথচ বাংলা সাহিত্যে-সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, আন্দোলনসহ কোনো দিকে থেকেই নজরুলের ভূমিকা ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি চিরকাল শোষিত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও সংগীত জগতে তিনি নিয়ে এসেছেন সৃষ্টি সুখের উল্লাস।’

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় কবিকে স্বল্প মূল্যায়ন অতি দুঃখজনক! তার প্রতি অবহেলার একমাত্র কারণ তিনি ইসলামী চেতনা ও আদর্শকে পুরোপুরিভাবে বিসর্জন দিতে পারেননি; ফলে নজরুল রয়ে গেলেন বাঙালি সমাজে অবহেলিত। জাতীয় কবির প্রতি এত অবজ্ঞা, এত অবহেলা কেন? নজরুল ভক্তসহ সুধীমহল আজকের এই জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে এর অবসান চান। কবি নজরুলের কবিতা ও গান-গজল আমাদের সংস্কৃতির চিরসম্পদ। তার দেশত্মবোধক কবিতাগুলো লাখ লাখ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং অনুপ্রাণিত করেছে বীরত্বপূর্ণ ও নিঃস্বার্থ কাজে আত্মনিয়োগ করতে।

আমরা যদি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য থেকে এই আদর্শটুকু গ্রহণ করতে পারি, তাহলে তার আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে এবং সমাজ অনেকখানি স্বচ্ছতার দিকে এগিয়ে যাবে। নজরুল সাহিত্যকে বর্তমান প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা আমাদের ওপর অপরিহার্য কর্তব্য। কবির জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে কবিকে স্মরণ করছি এবং তার ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য মহামহিমের দরবারে মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহতায়ালা কবিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করুন।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন মাত্র ২৩ বছর হলেও সাহিত্যজীবন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কবিতা, সংগীত, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটকসহ সব কিছু মিলিয়ে তার রচনা সংখ্যা অনেক। তার প্রথম প্রকাশিত রচনা মুক্তি (১৩২৬) বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায়। তিনটি ছিল কবিতা। প্রথম প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ প্রকাশিত হয় ‘সওগাতে’ ১৩২৬ সালে, কার্তিক সংখ্যায়। ছাপার হরফে আত্মপ্রকাশ ১৯১৯ সালে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারিতে।

প্রথম গদ্য প্রবন্ধ ‘যুগবাণী’ (১৯২২)। প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২)। ২৩ বছরের শিল্পজীবনে নজরুল লিখেন ২২টি কবিতা গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ, দুটি কিশোর কাব্য, তিনটি উপন্যাস, তিনটি গল্পগ্রন্থ, তিনটি নাটক, দুটি কিশোর নাটিকা, পাঁচটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, ১৪টি সংগীত গ্রন্থ। (আবদুল মান্নান সৈয়দ-নজরুল ইসলাম কবি ও কবিতা, নজরুল একাডেমি ঢাকা-প্রথম প্রকাশ ২৯ আগস্ট ১৯৭৭)। মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি ফিরে পেতে হলে নজরুলকে জানতে হবে এবং সর্বস্তরে নজরুলচর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। কবি নজরুল তার বিরল প্রতিভা গুণে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং যুগ যুগ ধরে আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Email : [email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কাজী নজরুল ইসলাম,বিদ্রোহী কবি,কবিতা,জাতীয় কবি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close