পাঠান সোহাগ

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

শিশু একাডেমিতে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ

দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শিশুদের প্রতিভা বিকাশ হচ্ছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে। এ ছাড়া শিশু চলচ্চিত্র নির্মাণ, দ্বিবার্ষিক আন্তর্জাতিক শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শিশু সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল বিদেশে প্রেরণ, মেয়ে-শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম, শিশুদের নির্বাচিত চিত্র সংরক্ষণ ও প্রদর্শনী, শিক্ষা সফর ও পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণেরও আয়োজন করে একাডেমি।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। এই শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে কাজ করছে শিশু একাডেমি। সারা দেশে একাডেমির ৭০টি শাখা বিভিন্ন বিষয়ে ৩৫ হাজার শিশুকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একাডেমির উদ্যোগে একটি মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকা এবং শিশুদের উপযোগী করে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫টি বই প্রকাশ করা হয়।

শিশু একাডেমির সহকারী পরিচালক মো. আমির হোসেন খান বলেন, প্রতি বছরই জাপান, তুরস্ক, ভারত, লেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশু সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়। আমাদের শিশুরা বিদেশ গিয়েও সুনাম রাখছে। বিভিন্ন দিবস ও বিশেষ দিনে একাডেমি নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে।

জানা যায়, শিশু একাডেমি মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশ বলে এ একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সারা দেশে একাডেমির ৭০টি শাখা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দোয়েল চত্বর সড়কে একাডেমির প্রধান কার্যালয়। প্রায় ৩.৬৯ একর জমির ওপর চারটি ভবনে শিশু একাডেমির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মোট ছয়টি বিভাগ রয়েছে। একাডেমির মূল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় এখান থেকেই। দেশের জেলা ও উপজেলা শাখ এ কর্মসূচি অনুসরণ করে।

শিশু একাডেমির সহকারী পরিচালক মো. আমির হোসেন খান বলেন, একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা ১৯৭৮ সাল থেকে হয়ে আসছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার ৬২টি বিষয়ে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় এ চারটি পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সারা দেশে থেকে প্রায় ৩ লাখ শিশু অংশ নেয়। শিশু একাডেমির দ্বিতীয় বৃহত্তম সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে মৌসুমি প্রতিযোগিতা। শিশুদের মধ্যে দলগত সমঝোতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করা হয়।

প্রশিক্ষণ শাখা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সাল থেকে একাডেমিতে শিশুদের জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়। এসবের মধ্যে চিত্রাঙ্কন, সংগীত, নৃত্য, নাট্যকলা, আবৃত্তি, উচ্চারণ ও সরব পাঠ, তবলা, গিটার, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা, দাবা, সুন্দর হাতের লেখা ও কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রোগ্রাম অফিসার ও মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ফারুক নওয়াজ বলেন, একাডেমি এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে দেড় হাজারে মতো বই প্রকাশ করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান শিশু-গ্রন্থমালা প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১০-২০১৩ অর্থ বছরে মোট ২৫টি বই ২ লাখ ৭০ হাজার কপি প্রকাশ করেছে এ একাডেমি।

দেশের বিশিষ্ট লেখকদের মানসম্মত শিশুসাহিত্য রচনায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে প্রবর্তন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।’ ১৯৮১ সাল থেকে প্রতিবছর বুক ইলাস্ট্রেশনসহ ৭টি বিভাগে বছরের সেরা বইয়ের জন্য ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য ও শিশু নাট্য পুরস্কার’ পুরস্কার দেওয়া হয়। অগ্রণী ব্যাংকের অর্থায়নে প্রতি বছরে এ পুরস্কার প্রদান করে থাকে।

দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করা ও জ্ঞানদানের উদ্দেশে গড়ে তোলা হয়েছে ‘শেখ রাসেল শিশু জাদুঘর’। একাডেমির কেন্দ্রীয় অফিসের জাদুঘরে ৭২টি শোকেসে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

শিশু একাডেমির সহকারী পরিচালক ও শেখ রাসেল শিশু জাদুঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন খান বলেন, জাদুঘরের নিচতলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ ক্ষুদে শিল্পীদের অঙ্কন করা চিত্রকর্ম ও দেয়াল পত্রিকার সমন্বয় করে রাখা আছে। দ্বিতীয়তলায় ৭২টি শোকেসে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত নানা চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিশুতোষ গ্রন্থাগার। শেখ রাসেল নামে এই গ্রন্থাগারে নিরিবিলি পরিবেশ। একসঙ্গে ২০০ শিশু-কিশোরের বসে বই পাঠের সুবিধা রয়েছে এখানে। শিশুতোষ গ্রন্থাগার বলে শুধু যে শিশু-কিশোরাই এই গ্রন্থাগারে আসে তা কিন্তু নয়। প্রতিদিনই নানা গবেষণার কাজে এখানে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ গবেষকরা। কারণ এখানে রয়েছে পাঁচ শতাধিক বিশ্বকোষ ও জার্নাল। এ ছাড়াও রয়েছে ৩২ হাজারেরও বেশি বই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনী গ্রন্থের সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে এই গ্রন্থাগারে।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কেন্দ্রীয় অফিসেই নয়, সকল শাখা অফিসসমূহে শিশু গ্রন্থাগার রয়েছে। এতে শিশুদের উপযোগী দেশি ও বিদেশি বই রয়েছে। গ্রন্থাগারে এসে শিশু-কিশোররা ও শিশুবিষয়ক গবেষকগণ বই ও পত্রপত্রিকা পড়তে পারে ও নিয়মিত সদস্যরা বাড়িতে বই নিয়ে যেতে পারে। শিশুদের মধ্যে পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি ও গ্রন্থাগারের প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার উদ্দেশে গ্রন্থাগারভিত্তিক বিভিন্ন প্রকার শিক্ষামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বই পাঠের পাশাপাশি শিশুদেরকে প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থাগারটিতে মিডিয়া ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন কর্নার তৈরি করা হয়েছে। যেখানে শিশুদের কমপিউটার, ইন্টারনেট, ব্লগিং, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক আনজীর লিটন জানান, শিশুদের অধিকার এবং শারীরিক-মানসিক ও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করছে একাডেমি। সারা দেশে একাডেমির ৭০টি শাখা রয়েছে। সব কটিতেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি প্রশিকক্ষণ কার্যক্রম চলে।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রতিবছরের মতো এ বছরও আয়োজন করেছে শিশুদের দলগত পরিবেশনায় ৪১তম মৌসুমি প্রতিযোগিতা। বিগত বছরগুলোতে প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল চারটি। এ বছর থেকে নতুন বিষয় দেয়ালিকা সংযুক্ত করে পাঁচটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে প্রতিযোগিতা হতো অঞ্চলভিত্তিক। এবার বিভাগওয়ারি করা হয়েছে।

৪১তম মৌসুমি প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে ৪৯ হাজার ২৬৬জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর সারা দেশে এ প্রতিযোগিতা হয়। এবার জাতীয় পর্যায়ে মৌসুমি প্রতিযোগিতায় চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়েছে ৬০ জন। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক, ক্রেস্ট ও সনদপত্র।

আনজীর লিটন জানান, অতীতে মৌসুমি প্রতিযোগিতায় বিজয়ীরা আজ অনেকেই দেশের কল্যাণমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। তারা সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি,শিশু একাডেমি,শিশুতোষ গ্রন্থাগার,সৃজনশীল প্রতিভা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close