কাউসার মাহমুদ

  ২২ জুন, ২০১৮

নাবিলকে মনে পড়ে গল্পের মতোই

ফ্রেডরিখ নিৎসে (১৮৪৪-১৯০০) বলেছেন, ‘বন্ধু হচ্ছে ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’ এর মাঝখানের একটি সত্তা। সত্যিকার বন্ধুই হতে পারে শ্রেষ্ঠ শত্রু।’

তেপান্তর ছাপিয়ে গভীর শূন্যতা বিরাজিত একটি গল্প নির্মাণে মনোযোগী হচ্ছি বোধহয়। সময়টা বেঁধে আছে ঘড়ির কাটায়। একটা সাতচল্লিশে বসেছি এখন। আমার কালো কেদারাটা নিশ্চুপ সায় দিচ্ছে। লিখে যাও বলে কে যেন টোকা দিচ্ছে ঘাড়ের বামপাশে।

আমার প্রেমিকা বিয়োগ হয়েছে গত দুদিন হলো। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ‘ভাঙাগড়া’ একটা ঢেউয়ের মতো। কখনো নিশ্চুপ কলকল বেয়ে চলে আমাদের প্রেম শোভাযাত্রা। কখনোবা আবার সমুদ্র তরঙ্গায়িত উত্তাল উর্মিমালা আছড়ে পড়ে আমাদের মনের বারান্দায়। জলে ভিজে চুবচুব আনমনা হয়ে অভিমানপত্র পাঠাই। একূল-ওকূল করে আমরা গোমড়ামুখে সেঁটে থাকি দেয়ালে দেয়ালে। দিন কয়েক বাদে আবার ফিরে আসি পুরনো মোহনায়। হাস্যরস আর বেদম প্রণয় ভেঙে তুমুল প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তবে, এবারের বিষয়টা ভিন্ন। তুচ্ছ একটা বিষয়ে আমাদের ভেতর বর্তমানে চলছে এক শীতল বৈরীতা। কোনো উপলক্ষ ছাড়াই এমন নির্ঘুম অভিমান বড্ড ভয়ঙ্কর। এখানে দোষী-নির্দোষ ঠাহর করা বিপজ্জনক। সুতরাং, আমার প্রেমিকা বিয়োগ একজন বোহেমিয়ান অনুর্বর প্রেমিক হিসেবে অনেকটাই নিশ্চিত। এই হলো আমার বর্তমান প্রেম সমাচার। এই গল্পের পরবর্তী সব কিছুই, বিষয়বস্তু হিসেবে লেখ্য গল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। প্রচ্ছন্ন কিংবা অধিকতর সংবেদী হয়ে এ দুটো মিলে যেতে পারে কোনো অনুচ্ছেদ অথবা গল্পের মাঝপথে জমজ চরিত্র হয়ে। গল্পের পরবর্তী সমাচার বন্ধুত্ববিষয়ক। প্রেমিকা ও বন্ধু দুজনের সীমাবদ্ধতা কতটুকু কেটে থাকে আমাদের অনুরাগ, ভেতরের জলোচ্ছ্বাস!

দুই নাবিলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা একদম আনকোরা নয়। বছর আটেক তো হবেই। না না, ভুল বললাম। হিসেব করলাম মাত্র। আট বছর পড়াশোনা, বাকি দুবছর চাকরি। এইতো কোনো গরমিল নেই। পাক্কা দশ বছর। একটা মানুষকে সবুজ লাউয়ের ডগার মতোই বড় হতে দেখেছি আমি। আমাকেও দেখেছে ও। আমাদের শুরুটা কোথায় সেদিনটা অস্পষ্ট হয়ে আছে স্মৃতির অতীতে। এ ছাড়া সব ঠিকঠাক। দশ বছর ওর সঙ্গে কাটানো খুব কম দিনই এমন আছে, যেটা আমার ভুলে যাওয়া।

ক্যাম্পাসে ওর সঙ্গে প্রথম দেখা। আমার মতোই টিংটিঙে গড়নের একটা ছেলে। সদ্য ঢাকায় আসা বাড়ন্ত কিশোর। মুখে চপলতার ছাপ যত না দুর্দম, তারচেয়ে বেশি স্পিড ছিল ওর বলের গতিতে। মাঠে বিকেলে খেলতাম না যতটুকু, তারচেয়ে বেশি দেখতাম ওর বল করা। ভালো লাগত অনেক। আমার মতো অত ছুটো মন ছিল না ওর। প্রথমটায় একদম নিঃস্পৃহ ছিল ওর চলন-বলন। সিলেটি টান তখনো কথার ভাঁজে ভাঁজে। পাঞ্জাবিতে জালালি স্টাইল আর আড্ডা-চলায় রেওয়াজি কায়দা-কানুন। এভাবেই চলছে দেখা-সাক্ষাৎ, টুকটাক কথা।

আমাদের ক্লাস ছিল ভিন্ন। ও পড়ত আমার এক ক্লাস ওপরে। কিন্তু প্রথমদিনই আমরা পরস্পরকে তুমি বলেছিলাম মনে আছে। আপনিটা আমাদের মাঝে পরবর্তী জীবনে রাগ-অভিমানে ব্যবহার হয়েছিল। সে অন্য কথা। অতীত যেখানে জড়িয়ে থাকা মৃত্তিকা অবয়ব।


সম্প্রতি আমাদের দূরত্বটা পুরনো হয়ে গেছে। যে যার মতো চলছি, চলছে। আমার টেবিলে পড়ে আছে কোলকাতার দেশ পত্রিকাটি, এপ্রিল ১৮ সংখ্যা। দুই কবি সুবোধ সরকার আর জয় গোস্বামীর চুয়াল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব দেখে মনে হলো—কেমন আছে নাবিল?


আমাদের দৌড়ঝাঁপ, চলাচল, শহর বেড়ানো—সব এক সঙ্গেই চলছিল। আত্মার অব্যক্ত সম্মেলন হতে থাকল আমাদের ভেতর। কথা চুরি, লুকনো অন্তর ক্রমেই আমাদের দুরন্ত শৈশবকে বেঁধে দিল এক ভিন্ন মায়ায়। গভীর আচ্ছাদনে বাঁধা পড়ল আমাদের মন। জুতোর ফিতে থেকে পাজামার ডোরা, চুলের বাকানো আঁচড় একসঙ্গেই হতে চলল বুঝি। সবটাই আমাদের পরস্পরের সাহায্যে। ধীরে ধীরে আমরা বন্ধু হয়ে যাচ্ছিলাম বুঝি। হৃদয়ের সমস্ত দিয়ে গুনতে থাকি দোস্তির কথা। যে কথা আমার ও নাবিলের। সে বয়সে আমাদের প্রেম ছিল ‘তুই তুই’ তে। বন্ধুত্ব বলতে বুঝেছিলাম ‘তোর জন্য মরা যায়’ এর মতোন মিথ ভাবনা। তবে, এরচেয়ে কোনো অংশে কম যে ভেবেছি তখন এমনও না। এখন না হয় সাত-পাঁচ ভেবে জীবনকে পেঁচিয়ে রাখি নিজের জন্য। মৃত্যুকে ভয় করি অনিঃশেষের মতো। কিন্তু সে সময়ে এতটা হ্যাংলা আর গাদ্দার ছিলাম না। বাস্তবই কিশোর মনের পৃথিবীতে আমার বন্ধু নাবিলের জন্য ছিল আলাদা সাম্রাজ্য। আমাদের সে বয়সে প্রেমিকা প্রেম বুঝিনি একটুও। তবে অসামান্য সুরম্য সৌধ বানিয়ে বিস্তৃত করে রেখেছিলাম বন্ধুর দুয়ার। আমাদের ছিল বন্ধু প্রেম। নাবিল আর আমি ক্রমেই চলতে শুরু করি পৃথিবীর পরিচিত গলিতে গলিতে। আমাদের স্বপ্ন এক। ভাবনার জানালাগুলো ভোর হলে একসঙ্গেই মেলাতাম হাসতে হাসতে।

আমরা বোধহয় বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের দুটো অন্তর যেন অববাহিকা নদ। স্ফূটিক সচ্ছ জলাশয় ভরা মায়া আর মায়া। দুজনের আনন্দ ভাগ করা থাকত এক পাল্লায়। সেখান থেকে উল্লাস ছুঁঁয়ে মাখিয়ে দিতাম একে অন্যের গায়। নাবিলকে পৃথিবীর প্রিয় মানুষদের থেকে মনে মনে আলাদা করেছিলাম কবে, কোনদিন কে জানে! তবে, আস্তে আস্তে এটা প্রকট হতে থাকল। ওর জন্য শুদ্ধির একটা প্রতিবিম্ব বানালাম ভাবনায় ভাবনায়। ও ভিন্ন ওর অস্তিত্ব ভিন্ন আমার কাছে। সে আমার বন্ধু। আমার আরেকটি আমি। কখনো মনে হয়েছে এরচেয়েও বেশি কিছু। প্রকৃত বন্ধুত্ব কি এমনই হয় কি না, আমার জানা ছিল না। নাবিলও যে আমাকে এমন ভাবত না সেটাও অবিশ্বাস্য। ওর আচরণ কথা বলা অনেক বছর এমনই ছিল।

বন্ধু ঠিক আমর মতোই। বেপরোয়া টান। অস্থিতে অস্থিতে মিশে থাকা ভ্রাতৃত্ববোধ। এ ছিল আমাদের অমনোযোগী কৈশোরকালের শুরুর সময়। এভাবেই চলছিল আমাদের দিনকাল। আনন্দ অভিমানের যুগপৎ সময়সন্ধ্যা। এরপর বয়স ও সময় দুটোই কি ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল আমাদের মাঝে! তাহলে বন্ধুত্বটা কি ছিল! সেটা কি মিথ্যে! না হলে অনুক্ষণ এত কষ্ট পোহাতে হতো কেন! কেন এত মনে পড়ত চিকচিক সোনামুখো রোদ। গাছের ডাল, পাখির পাখনা গোনা দুরন্তপনা। সমুদ্র, পাহাড়, একসঙ্গে হেঁটে আসা অতীত দীর্ঘপথ। ট্রেনে চড়া, পল্টন ঘুরে বই কেনা, রমনার ছবি, দোলনায় বসে ‘শালা পড়ে যাবি তো’ বলেই হাত ধরে টান। কোথায় এইসব ধুলোমাখা স্মৃতির আস্তরণ।

তিন আমাদের বয়স গড়াল আমাদের সামনেই বেড়ে ওঠা কদম গাছটির সঙ্গে। আমরা যখন ক্যাম্পাসে তখন ওটা ছিল এই এইটুকুন। ছোট্ট একটি কদম চাড়া। দশ বছর পর ওটা এখন গাছ। প্রতি বসন্তেই এর ফুল আমাদের দেখা। পাশের আম গাছটি তো লাগিয়েছিলাম আমরাই। ওটাও এখন বেশ বড়সড় দীর্ঘকায়। কত বড় বড় ডাল। মুকুলও আসছে বেশ ক’বছর ধরে। প্রকৃতির নিয়ন্ত্রিত সীমারেখায় পাল্টেছে এ গাছগুলো। ঠিক তার পাশেই পাল্টে গেছে নাবিল অথবা আমি। আমার মনে হয় নাবিলই।

পড়াশোনা শেষ দুজনেরই। একই ক্যাম্পাস থেকে এক বছর আগে-পরে বেরিয়েছি আমরা। মনে পড়ে, ওর বিদায়ী অনুষ্ঠানের কথা। নাবিল চলে যাচ্ছে! তাহলে আমি! এরপর আর ভাবতে পারিনি একটুও। ওকে জড়িয়ে ধরে কাদিওনি সামান্য। সে বেলায় আকাশ দেখেছিলেম আমি। আমার বন্ধুর পরিপূরক ওই একটি জায়গায়ই ছিল বুঝি। নীল সবুজাভ বিচিত্র প্রকৃতির দিগন্তপ্রসারী আকাশ। যদিও এর মাঝের অনেক কথাই লুকিয়ে রেখেছি শীর্ণ চাপরাশির মতোই। তবে একটা প্রচ্ছন্ন সমীকরণ এই গল্পে মাত্রা যোগ করবে আমার টানের। আমার বোধের।

আমাদের সার্কেল ছিল একটিই। অনেক বন্ধুর সঙ্গে নাবিলের পরিচিতিটা আমার হয়েই। এই ছুটে চলা। আড্ডাবাজিতে গত হওয়া রাত এবং দীপন, সবুজ, হৃদয়, সুমিতের আরো কাছে এসে অধিকার খাটানো আমার কাছে ঈর্ষা ঠেকত। মনে হতো, নাবিলকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বুঝি। কবিতার বাতিক ছিল আমাদের দুজনেরই। সাহিত্যটা ছিল বেঁচে থাকার ভিন্ন অনুষঙ্গ। সে অন্য কথা। নাবিল ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠল আমাদের পরিচিত অঙ্গনে। পড়াশোনা শেষ করে কানাডায় যাওয়ার প্লান। উড়ো সময় কী আর করবে, আবার ঢাকায় এসে থিতু হল এক বন্ধুর মেসে। আমার সে বছর লাস্ট ইয়ার। ও থাকে আমার একটু দূরেই। কিন্তু খোঁজটা আর নেওয়া হয়ে ওঠে না ওর। আমিই বরং আগবাড়িয়ে কিছুদিন এদিক-ওদিক করে ঘুরে এসেছিলাম ওর ঘর।

আজকে আসিস বললে রাত এগারোটায় ফোনে বলতো, আজকে পারলাম না। ওদের সঙ্গে গেলাম ওখানে, দেখি কালকে! এভাবে শুরু ব্যবচ্ছেদের। এর মাঝে অপূর্ণ মিথ্যের অনেক ব্যথিত কষ্টালাপ আমি লুকিয়ে এসেছি। আমার বন্ধু ধীরে ধীরে আমার থেকে দূরে সরলো। ওর অবয়ব আর ওপরের অভিনয় ছাপ আমি বুঝতাম। তবুও ওই তো আমার বন্ধু। তাছাড়া এতে দোষেরই বা কী। মানুষের মন ও ভাবনাবোধ কখনো কি স্থির থাকে! এই বলে নিজের বন্ধুত্বকে আরেকটু শুদ্ধির জলে ডুবিয়ে দিতাম নিত্য। যেটা এখনো করছি নিয়ম করে।

সম্প্রতি আমাদের দূরত্বটা পুরনো হয়ে গেছে। যে যার মতো চলছি, চলছে। আমার টেবিলে পড়ে আছে কোলকাতার দেশ পত্রিকাটি, এপ্রিল ১৮ সংখ্যা। দুই কবি সুবোধ সরকার আর জয় গোস্বামীর চুয়াল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব দেখে মনে হলো—কেমন আছে নাবিল?

এ আমি ভাবি নিত্য। মনে করি অতীতস্মৃতি। ধূসর গোধূলি আলিঙ্গনে বিস্তৃত আমাদের একলা পথ। হৃদয়ের অবিকৃত সেই কৈশোরটা যে এখনো জেগে ওঠে তেইশের বালুচরে। কতইবা হয়েছে আমার বয়স। কবিরা, বিখ্যাতরা স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আত্মকথায় এই সমস্ত লিখে। তাদের পুরনো দুরস্ত কলম এইসব গল্প লিখে অভিজাত গদ্যে। সেখানে আমি কে? নিঃস্ব উড়নচন্ডি ইমোশনালাজিমে ভোগা এক আরক্ত কথক। কিছু ছাড়া ছাড়া শব্দে লিখছি ‘বন্ধুত্বের গল্প’ একদমই সুপেয় নয় এর ব্যঞ্জনা জানি। তবুও নাবিলকে মনে পড়ে গল্পের মতোই।

লেখক : কবি ও গল্পকার [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাহিত্য,কাউসার মাহমুদ,গল্প
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist