কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২০ মে, ২০১৮

চট্টগ্রামে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর ঐতিহ্যের তথ্যভাণ্ডার

কিভাবে সাচিয়াকুম (গোহত্যা) উদ্যাপন করে মুরংরা? খাসিয়া, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী কিংবা সিন্ধি আদিবাসীদের জীবনযাত্রা কেমন? পিঠে শিশু নিয়ে গারো নারী কিংবা পাহাড়ি এলাকায় জুমচাষ বা মাচা ঘরে বসে থাকা চাকমা নারী-পুরুষের দৃশ্য অথবা আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর পোশাক— সবই চোখে পড়বে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে গেলে। বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ঐতিহ্য আর স্থানিক ইতিহাসের মেলবন্ধন হয়েছে এই জাদুঘরে।

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক আচার, ঐতিহ্যের নমুনা সংরক্ষণের উদ্দেশেই এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে নির্মিত জাদুঘরটি ১৯৭৪ সালে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। ওই বছরের ৯ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী এ জাদুঘর উদ্বোধন করেন। নান্দনিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশে ১ দশমিক ২৫ একর জমিতে আগ্রাবাদের বাণিজ্যিক এলাকায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জাদুঘরটি।

বর্তমানে জাদুঘরটিতে ১২টি জনগোষ্ঠী এবং ২৬টি মৌলগোষ্ঠী ও আদিবাসীর নিদর্শন রয়েছে। বাঙালি জাতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ঘরোয়া জীবন, দৈহিক গড়ন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক আচার, পোশাক, খাদ্য, উৎসব, হস্তশিল্প, ধর্মীয় কাজ, অলংকারের নিদর্শন রয়েছে এতে। আলোকচিত্র, মডেল, নমুনার মাধ্যমে জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্বতা তুলে ধরা হয়েছে।

এ জাদুঘরে একটি কেন্দ্রীয় হলঘরসহ মোট চারটি গ্যালারি রয়েছে। জাদুঘরে মোট ১১টি কক্ষ রয়েছে। প্রবেশমুখে চোখ বুলিয়ে নিলে জাদুঘরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং জনগোষ্ঠী ও মৌলগোষ্ঠীর অবস্থান সম্পর্কে মানচিত্রের নির্দেশনা দেখতে পাওয়া যায়। এক নম্বর গ্যালারির প্রথম কক্ষে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের আলোকচিত্র, কৃষিকাজসহ মাছধরা ও হিন্দু,

মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-এর মিলনের প্রতিকৃতি, দেশের জাতীয় ফলসহ কৃষিলভ্য পণ্য, পশু পাখির মডেল রয়েছে। ওই গ্যালারিতে দ্বিতীয় কক্ষে দেখা যায়, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের কিছুসংখ্যক জনগোষ্ঠী ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর লোকায়ত জীবনব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী দ্রব্যাদি ও মডেল। এছাড়া জার্মান প্রাচীরের কিছু ধ্বংসাবশেষ এবং পাকিস্তানে বসবাসকারী পাঞ্জাবি, সিন্ধি ও পাঠানদের জীবনব্যবস্থার ধরন, পোশাক, শিকারের সামগ্রী ও নিদর্শনাদি রয়েছে।

দুই নম্বর গ্যালারির প্রথম কক্ষে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী মণিপুরী, খাসিয়া ও পাঙনদের পরিচিতি রয়েছে। সেখানে তাদের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পোশাক, রাসনৃত্যের পোশাক ইত্যাদি রয়েছে। দ্বিতীয় কক্ষে পলিয়া বা বাবুবলি ও সাঁওতালদের রান্নার দৃশ্য ও গৃহস্থালি পরিবেশ, গারোদের জীবনচিত্র ও মডেল, ঘরোয়া পরিবেশ, শিকারের দ্রব্যাদি, মাছ ধরার বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্রশস্ত্র, মৃত বাড়ির পাশে পুঁতে রাখার ফলক উপস্থাপনা করা হয়েছে। ওই কক্ষে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী গারো, রাজবংশী, ওঁরাওদের নিদর্শনও রয়েছে।

তিন নম্বর গ্যালারির প্রথম কক্ষে রয়েছে ম্রো আদিবাসীর বিভিন্ন আলোকচিত্রসহ তাদের ব্যবহার করা সামগ্রী, বাদযন্ত্র, কৃষিকাজে ব্যবহার করা সামগ্রী, মাথার চুল ও চিরুনী। দ্বিতীয় কক্ষে রয়েছে ত্রিপুরা, পাংখোদের জীবনব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। বম জনগোষ্ঠীর প্রতিকৃতি, পোশাক, বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি হাজংদের কৃষিকাজে ব্যবহার করা উপকরণ ও হস্তশিল্পজাত দ্রব্য রয়েছে তৃতীয় কক্ষে।

চার নম্বর গ্যালারির প্রথম কক্ষে চাকমাদের বিভিন্ন পরিবেশে আলোকচিত্র, চাকমা রমণীর মডেলসহ পোশাক-পরিচ্ছদ, চাকমাদের কাপড় বুনন, পাশা খেলার ঘর, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, গৃহস্থালি পরিবেশের দৃশ্য রয়েছে। দ্বিতীয় কক্ষে মারমাদের মডেল, পোশাক-পরিচ্ছদ, গৃহস্থালির পরিবেশ ও ঘরে মদ তৈরির দৃশ্য আছে। তৃতীয় কক্ষে বিভিন্ন আদিবাসীর জীবনযাত্রায় দৈনন্দিন ব্যবহার করা সামগ্রী, পাখিসহ বিভিন্ন বন্যজন্তুর হাড়, কচ্ছপের খোলস, বড় আকৃতির সাপের চামড়া, পটুয়াখালীতে বসবাসরত রাখাইন আদিবাসীর জীবনযাত্রার এবং পিতলের তৈরি বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে। কেন্দ্রীয় কক্ষে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, মৌলগোষ্ঠী ও আধিবাসীদের অলংকারাদি। উত্তর দেয়ালে রয়েছে প্রাকৃতিক ও গৃহ পরিবেশের সান্নিধ্যে মুরং গোহত্যা উৎসবের মডেল।

সম্প্রতি জাদুঘরটিতে ঘুরতে আসেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থী তাওহীদুল ইসলাম; তিনি বলেন, জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে ভালো লাগছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে বইয়ে পড়া তথ্যগুলো এখানে এসে মেলাতে পেরেছি। তবে জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিস্তারিত বিবরণমূলক লেখা থাকলে ভালো হত।

প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর একটি বিশেষায়িত জাদুঘর। যেকোনো দর্শক বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, কিরগিজস্থান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পাবেন এই জাদুঘরে এলে। জাদুঘরের নিদর্শনগুলো আধুনিকভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাদুঘরটিকে আন্তর্জাতিক মানে পরিণত করতে সামনে আরো পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর,ঐতিহ্য,তথ্যভাণ্ডার,চট্টগ্রাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist